সোমবার, ৩০ Jun ২০২৫, ০৭:৫০ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

চব্বিশে চৌদ্দ-আঠারোর চাপে ইসি

মোস্তফা কামাল:
চাপ বোধ গোপন রাখেননি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। প্রশ্ন আউটের মতো ফাঁস করে ফেলেছেন। বাস্তবতা বোঝাতে গিয়ে ২০১৪-১৮ সালের পূর্বসূরিদের কথা টেনে আনলেন। বলেই ফেললেন ‘২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন বিতর্কের ‘চাপ’ আমাদের ওপর এসে পড়েছে। তাই আমাদের দায়িত্ব বেশ।’ আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করতে চ্যালেঞ্জের কথাও জানান সিইসি। ঘটনা অনেকটা ঘাসের গল্পের মতো নিজের ধুতি-লুঙ্গিতেও টান দিয়ে ফেলা। তবে সামনের নির্বাচনে তিনি যে চৌদ্দ-আঠারোর বাইরে নির্বাচনের কোনো ছাপ দেখাতে চান, সেই আভাসও দিতে পারেননি।

পরপর দুটো সংসদ নির্বাচন নিয়ে মানুষের অভিযোগ সরকার কথার তুরিতে উড়িয়ে দেওয়ার এই পথে সিইসি রাজসাক্ষী হয়ে ১৪ এবং ১৮ সালের নির্বাচনী ভেজালের স্বীকারোক্তি দিয়ে বসলেন। এমন ভেজাল কাণ্ড তার আমলে হবে না, সেই গ্যারান্টি দিয়েছেন। দিনের ভোট আর রাতে হবে না সেই ওয়াদাও দিয়েছেন। এসবের মধ্য দিয়ে সিইসি তার সদিচ্ছা-আন্তরিকতা ও চেষ্টার বার্তা দিচ্ছেন সত্য। কিন্তু, বাস্তবতা বহু দূরে। তার কথা বা নিয়ন্ত্রণ কি সরকার মানবে? ডিসি-ওসিরাই কি কমিশনকে কেয়ার করছেন? ক্ষমতায় থাকা ছাড়া আওয়ামী লীগের সামনে গতি নেই বললেই চলে। আবার সুষ্ঠু নির্বাচনে জিতে আসার আত্মবিশ্বাসও তাদের অনেকের নেই। ‘মাননীয় সংসদ সদস্য’ নামে সম্বোধন করতে হয় এমন বহুজনের ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বার হওয়ার অবস্থাও নেই। তাদের কাছে ১৪-১৮ মডেল খুব কাম্য। তারা ধারে-ভারে বড় কড়া।

সরকারের শীর্ষ পর্যায় চাইলেও তারা একটি আদর্শ নির্বাচনে বাদ সাধবেন। আবার একটি কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দিলেও এ মুহূর্তে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা অবশিষ্ট নেই বললেই চলে। ভেতরের নলচে পাল্টানো ছাড়া শুধু ওপরের খোল পাল্টিয়ে ফল পাওয়ার দিন শেষ। অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিস্থিতিই নেই। কয়েক দিন বা কয়েক মাসে সেই পরিস্থিতি করে ফেলার আশাও দুরূহ। অবশ্য, নির্বাচন নিয়ে কিছুদিন পরপর ষাঁড়ের লড়াইয়ের বলি হওয়ার ঘটনা যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে এ দেশের জনগণের।

গত অর্ধশত বছরে রাজনৈতিক দল বা শক্তিগুলো নির্বাচনকে একটা পদ্ধতি বা নিয়মে আনতে না পারার এ পরিণতি ও মাশুল দিতে হচ্ছে দেশকে। দীর্ঘ এ সময়ে তারা ভোটের বহু মডেল দেখিয়েছেন বাংলাদেশকে। তাদের দেওয়া গণতন্ত্রেরও বহু মারপ্যাঁচ। একদলীয়, দ্বিদলীয়, কয়েক দলীয়, বহুদলীয় ইত্যাদি। ভোট আর নির্বাচনের তাই নামও অনেক। সুষ্ঠু নির্বাচন, নিরপেক্ষ নির্বাচন, অবাধ নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ভোটেরও নানা নাম-চিহ্ন। ভোট ক্যু, মিডিয়া ক্যু, বাক্স লুটের ভোট, হাঁ-না ভোট। সূক্ষ্ম, স্থূলসহ কারচুপিরও নানান কলসাইন। মাগুরা, মীরপুর, ১৫ ফেব্রুয়ারি, বিনা ভোট, রাতের ভোট ইত্যাদি। ‘সা.ল.সা নির্বাচন’ বলে কটাক্ষমূলক নামও আছে। সিইসি তার চাপের কথা জানিয়েছেন, কিন্তু সামনে ভোটের কোন ছাপ অপেক্ষা করছে, সেই আভাস দিতে পারেননি। বরং প্রশ্নের পারদ বাড়িয়েছেন। প্রশ্ন ও তাপদাহ পজিশন-অপজিশন দুদিকেই। সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-অবাধ-গ্রহণযোগ্য-আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ইত্যাদি বিশেষণযুক্ত নির্বাচনের কড়া তাগিদ যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বের। কিন্তু, সেই ভোটের ধরন সম্পর্কে ধারণা এখন পর্যন্ত একেবারেই অন্ধকারে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের অবিরাম তাগিদের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দল ও সরকার থেকে বলা হচ্ছে, সামনে একটি মডেল নির্বাচন হবে। কেমন হবে বা হতে পারে সেই মডেলটা, যা দেখার বাকি আছে? অথবা যা আর হয়নি বাংলাদেশে?

১৯৭৩ সালে স্বাধীন দেশের প্রথম নির্বাচনে একটি মডেল দেখেছে মানুষ। ওই নির্বাচনে খন্দকার মোশতাককে (পরবর্তী নাম খুনি মোশতাক) জয়ী দেখাতে ব্যালট বাক্স কুমিল্লা থেকে ঢাকা এনে অধিকতর সঠিক ফলাফল দেওয়ার ঘটনা ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত। নির্বাচনটি আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধুর ইমেজে চরম আঘাত হানে। এরপর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে হাঁ-না ভোট, আওয়ামী লীগকে নৌকা-মই ইত্যাদি ৪ ভাগে সিট বণ্টনসহ নানা মডেল শো। এ শোতে আরও নতুনত্ব আসে জেনারেল এরশাদ জমানায়। নির্বাচনের এই সিরিজ মডেল শোতে প্রথম ব্যতিক্রম আসে এরশাদ পতনের পর ১৯৯১-তে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে। স্বাধীন দেশে প্রথম স্বাধীন নির্বাচনের স্বাদ পায় মানুষ। তবে, ওই নির্বাচনে হেরে যাওয়া আজকের ক্ষমতাসীনদের কাছে সেটি ছিল সূক্ষ্ম কারচুপির মডেল। এর মধ্যেই গণ্ডগোল পাকে তখনকার বিএনপি সরকারের মাগুরা ও মীরপুর উপনির্বাচনী মডেলে। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারি মডেল। তারপর বিচারপতি হাবিবুর রহমান, লতিফুর রহমান, ফখরুদ্দিনদের তত্ত্বাবধায়ক জমানায় নির্বাচনের মোটামুটি একটি মডেল চলতে থাকে। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশে নির্বাচনী নাশকতা। হতে হতে ২০১৮ সালে এসে দিনের ভোট রাতে সেরে ফেলার নতুন মডেল গড়ার অভিযোগ। এর আগে, ২০১৪ সালে বিনাভোটেই ১৫৪ জনকে জয়ী ঘোষণার রেকর্ড। যারা এখন মডেল নির্বাচনের ওয়াদা শোনাচ্ছেন তারা একবারও বলছেন না ১৪ বা ১৮ সালের মডেলটি ঠিক ছিল না। বরং ১৫৪ জনকে বিনা ভোটে পাসের পক্ষে জোরালো যুক্তি তাদের। ২০১৮ সালে রাতে ভোট হয়নি, রাতের ভোটের কোনো প্রমাণ নেই বলে দাবিও করছেন। এ অবস্থায় তারা এবার কোন মডেল দেখাবেন, তা কেবল বিরোধী দল নয়, সাধারণ মানুষের কাছেও প্রশ্নবোধক। প্রধান নির্বাচন কমিশনার গ্যারান্টি দিয়ে বলছেন, এবার আর দিনের ভোট রাতে হতে দেওয়া হবে না। তার আগের জনের অঙ্গীকার ছিল ১৮ সালে ১৪ সালের মতো বিনা ভোটে ১৫৪ জনকে পাস করতে দেবেন না তিনি। কথা রেখেছেন, বিনাভোটে এমপি হওয়া কমিয়েছেন। কিন্তু ভোট রাতে এগিয়ে এনেছেন। আশা বা ধারণা করা যায়, ২৪-এর নির্বাচনে বর্তমান সিইসি তার ওয়াদা মতো রাতের ভোটের রেকর্ড ভাঙবেন, ভোটের কাজটি দিনেই করাবেন-করবেন। কিন্তু সেটা নতুন কোন মডেলে?

বাস্তবতা এখন অন্যরকম। ২০১৪-১৮ সালের মতো ভোটকাণ্ড এবার সম্ভব হবে না বলে ধারণা অনেকের। ধারণাটা কারও কারও কাছে বিশ্বাসের পর্যায়ে। এমন ধারণা ও বিশ্বাস অনেক কারণে। চলমান স্নায়ুযুদ্ধের এ সময়ে একতরফা কিছু করার সুযোগ এখন রুশ-উত্তর কোরিয়ার মতো কিছু দেশ ছাড়া আর কোনো দেশের নেই। গোটা দুনিয়ায় উদাহরণসহ শত্রু-মিত্রের সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। কোথাও কোথাও শত্রুই বন্ধু, বন্ধুই শত্রু। অথবা গতকালের বন্ধু আজ শত্রু। সেই হিসেবে বাংলাদেশের সামনের নির্বাচন কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। নানা কারণে অনেকের চোখ বাংলাদেশের সামনের নির্বাচনের দিকে। গাজীপুরের স্থানীয় সরকারের নির্বাচনও এখন কেবল জাতীয় নির্বাচন নয়, আন্তর্জাতিক কোনো নির্বাচনের কাছাকাছি।

ভৌগোলিক, ভূ-রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, রাশিয়া, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশেরই চোখ বাংলাদেশের ২৪ সালের নির্বাচনের দিকে। সেটি হবে কোন মডেল বা ছাপে? ক’দিন আগে ভোটের ধারণার একটি বোমা ছুড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ক ম জামালউদ্দিন। বিনাভোটে নির্বাচন নয়, বিনা নির্বাচনেই নির্বাচনের এক আচানক ধারণা দিয়ে বেশ ভাইরাল হয়েছিলেন তিনি। বিনাভোটে নির্বাচন হতে পারলে বিনা নির্বাচনেও নির্বাচন হতে পারে এমন একটি বার্তা ও যুক্তি রয়েছে তার তত্ত্বের মধ্যে। বেশ ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটি। নির্বাচন ছাড়া এ সংসদ ও সরকারকে আরও ৫ বছর টেনে নেওয়ার ফর্মুলাটির পক্ষে ভেতরে-ভেতরে কারও সায় আছে কি না তা অপেক্ষা করে দেখার বিষয়। তবে, রাস্তাঘাটে মানুষের মধ্যে ভোট নিয়ে হালকা মস্করা আছে। এভাবেই ভোট হলে এত টাকা খরচের কী দরকার এত দাঙ্গা-ফ্যাসাদ না করে ভোট আর লাগবে না মর্মে একটি আইন করে নিলেই তো হয় ক্ষোভ-বিরক্তি থেকেই এ ধরনের স্থূল কথার জন্ম। এরশাদ আমলেও ভোট ও নির্বাচন প্রশ্নে এমনতর খেদ-ক্ষোভ ছিল মানুষের মধ্যে। সময়ের ব্যবধানে সেইসঙ্গে নানা মস্করাও যোগ হয়েছে। উত্তর কোরিয়ার নির্বাচন স্টাইলও এ মস্করার একটি আইটেম। উত্তর কোরিয়ায় অল্প খরচে সুষ্ঠু, সুন্দর, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়। হানাহানি হয় না। কারচুপি-জালিয়াতির প্রশ্ন ওঠে না।

কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও কিম পরিবারের বংশপরম্পরায় শাসন করা দেশটিতে ক্ষমতাসীন নেতার প্রতি অবাধে, অংশগ্রহণমূলকভাবে আনুগত্য দেখায়। সেখানকার জনগণ, প্রশাসনসহ সবমহল এতে অভ্যস্ত। পাঁচ বছর পর পর সুষ্ঠু-সুন্দর, অংশগ্রহণমূলক-সুশৃঙ্খলভাবে তারা ভোট দেয়। তারা ভোরের আলো ফোটার আগেই ভোটকেন্দ্রে চলে যায়। দাঁড়িয়ে যায় বিশাল লম্বা লাইনে। ভোট দিয়ে চলে যায় না। কেন্দ্রের সামনে সবাই মিলে আনন্দ করে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে বলে স্লোগান দেয়। ক্ষমতাসীনদের জন্য তা যারপরনাই উপভোগ্য। না খেয়েও মুখ মুছে বা দাঁত খুঁচিয়ে খাওয়ার ভান দেখিয়ে সেই উপভোগে শরিক হতে বাধ্য বাদবাকিরা।

লেখকঃ সাংবাদিক-কলামিস্ট

mostofa71@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION